সৌর ও বায়ু বিদ্যুতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন: সিপিডি

বাংলাদেশে ২০৪০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূরণ করতে হলে ৩৫.২ বিলিয়ন থেকে ৪২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ দরকার হবে। তবে নীতিগত অসংগতি, জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধে সময়সীমাবদ্ধ পরিকল্পনার অভাব এবং বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার কারণে এই লক্ষ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
রবিবার (২৪ আগস্ট) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে “২০৪০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্মূল্যায়ন: ‘স্মার্ট’ লক্ষ্য ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পূর্বাভাস” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট মেহেদী হাসান শামীম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় নীতি পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য থেকে ৩০% বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫ অনুযায়ী একই লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমা ২০৪০ সাল। অপরদিকে সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় (আইইপিএমপি) ২০৪০ সালে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪০%, যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও কার্বন ক্যাপচারকেও “পরিচ্ছন্ন জ্বালানি” হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
বর্তমানে (মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত) জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ মাত্র ৩.৬%, যেখানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের সক্ষমতা ৪৩.৪% এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে।
সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, সরকারের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য খাত থেকে ১৮,১৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। অথচ বর্তমান পরিকল্পনায় রয়েছে মাত্র ১,৯৬৭ মেগাওয়াট, যা আগামী পাঁচ বছরে ১৬ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি ঘাটতি তৈরি করবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নবায়নযোগ্য খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে ২০২৫–২০৩৫ সময়ে, প্রায় ২৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১. সৌর শক্তি: ১৬.৫ বিলিয়ন ডলার
২. বায়ু শক্তি: ১২.৬ বিলিয়ন ডলার
৩. জলবিদ্যুৎ: ৬ বিলিয়ন ডলার
৪. আমদানি ও অন্যান্য খাত: ৭.৪ বিলিয়ন ডলার
সিপিডির মতে, ২০৪০ সালের মধ্যে সৌর বিদ্যুতের সক্ষমতা ৭০০ মেগাওয়াট থেকে ১৭,২২৯ মেগাওয়াটে এবং বায়ু বিদ্যুতের সক্ষমতা ৬২ মেগাওয়াট থেকে ১৩,৬২৫ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে হবে—যা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ মাত্র ২%। ২০৩০ সালের মধ্যে এটিকে ২০%-এ নিতে হলে ১২-১৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। দ্রুত টেন্ডার প্রক্রিয়া ও নীতিগত স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবেন বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যমান জীবাশ্ম জ্বালানি বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরের জন্য কোনো বাধ্যতামূলক পরিকল্পনা নেই। ফলে নবায়নযোগ্য প্রকল্পে অগ্রগতি হলেও অচল জীবাশ্ম কেন্দ্র টিকিয়ে রাখায় ব্যয়বহুল অতিরিক্ত সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “যদি নীতিগত অস্পষ্টতা বজায় থাকে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো না যায়, তবে বাংলাদেশ আর্থিক সংকট ও জলবায়ু লক্ষ্যে ব্যর্থতার ঝুঁকিতে পড়বে।”
সিপিডি নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে—
১. সব জাতীয় নীতি সমন্বয় করে ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০% নবায়নযোগ্য জ্বালানির একক লক্ষ্য নির্ধারণ।
২. ২০৩০ ও ২০৩৫ সালের জন্য স্পষ্ট মাইলফলকসহ বাস্তবায়ন পরিকল্পনা।
৩. জীবাশ্ম বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরের সময়সীমা নির্ধারণ।
৪. প্রতিবেশী দেশ থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ আমদানি ও আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
৫. এডিবি, বিশ্বব্যাংকসহ বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকের স্বল্পসুদে অর্থায়ন নিশ্চিত করা।
৬. গ্রিড অবকাঠামো ও সঞ্চয় প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ছাদে সৌরবিদ্যুৎ ও মিনি-গ্রিড ব্যবস্থা প্রসার।
অনুষ্ঠানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ সলিমুল্লাহ, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির চেয়ারম্যান রেজওয়ান খানসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন।