বাংলাদেশে অস্বাভাবিক ঋণের রেকর্ড: ৭.৫৬ লাখ কোটি টাকা

দেশের ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক ঋণের (ডিস্ট্রেসড লোন) পরিমাণ রেকর্ড গড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের শেষে এই অঙ্ক আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্যপ্রকাশিত ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট–২০২৪ এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে মোট বকেয়া ঋণের ৪৫ শতাংশই অস্বাভাবিক ঋণ। এ অঙ্ক ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের সমান, যা দেশের আর্থিক খাতের নাজুক অবস্থার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।
অস্বাভাবিক ঋণের ধরন:
১. খেলাপি ঋণ: ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা
২. পুনঃতফসিল করা ঋণ: ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা
৩. রাইট-অব করা ঋণ: ৬২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, “এটা হঠাৎ তৈরি হওয়া সমস্যা নয়, দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও শিথিল নীতি এর মূল কারণ। শীর্ষ ঋণখেলাপিদের দায়বদ্ধতার আওতায় না আনলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”
তিনি জানান, বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বিভিন্ন আদালতের মামলা জটে আটকে আছে।
কেন বাড়ছে অস্বাভাবিক ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে অ্যাসেট কোয়ালিটি দ্রুত অবনতির পেছনে রয়েছে—
১. অবিবেচক ঋণ বিতরণ
২. তদারকির দুর্বলতা
৩. ঋণ উদ্ধার কার্যক্রমের ধীরগতি
শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছেই প্রায় ৭৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্যমতে, ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংকট আরও প্রকট হয়। ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা পূর্বে যে সুবিধা পাচ্ছিলেন তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি বড় গ্রুপ যেমন এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা ব্যাপক খেলাপিতে জড়িয়ে পড়ে।
এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “অনেক সুনামধন্য কোম্পানিও অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে। ফলে তারা সময়মতো ঋণ শোধ করতে পারছে না, পুনঃতফসিল করছে—এতে ডিস্ট্রেসড লোন বাড়ছে।”
পুবালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আলী জানান, “পূর্ববর্তী সরকারের সময়কার অনিয়মের প্রভাব এখন ব্যাংক খাতকে চরম সমস্যায় ফেলেছে।”
অস্বাভাবিক ঋণের কারণে ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার হার (CRAR) ২০২৪ সালের শেষে নেমে এসেছে ৩.৮ শতাংশে; যা আন্তর্জাতিক মান (বাসেল–৩) অনুযায়ী ন্যূনতম ১০ শতাংশ থাকার কথা। ফলে ব্যাংকগুলোকে বিপুল প্রভিশন গঠন করতে হচ্ছে, যা মুনাফায় চাপ তৈরি করছে।
২০২২ সালে নীতি শিথিল করে পুনঃতফসিলের ডাউনপেমেন্ট কমানো হয়। বর্তমানে মাত্র ১ শতাংশ জমা দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ আছে। ২০২৪ সালে এক বছরেই ৮৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা পুনঃতফসিল হয়েছে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই পুনঃতফসিল ঋণের ৩৮ শতাংশ আবার খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করছেন, দীর্ঘ অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ব্যাংক খাত এখন মারাত্মক চাপে। অস্বাভাবিক ঋণের বোঝা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফেরানো সম্ভব নয়।