“হাসপাতাল আছে, সেবা নেই: তালাবদ্ধ স্বাস্থ্যব্যবস্থা”

চারপাশে নিশ্চুপতা। বিশাল ভবন, উঁচু গেট—কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় তালা মারা দরজা, ফাঁকা করিডোর আর হতাশ মুখে ফিরে যাওয়া নারী-শিশু। এ যেন অবকাঠামোর মধ্যে বন্দি এক সেবা-প্রতীক্ষা।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পেড়লি ইউনিয়নের খড়রিয়া বাজারে অবস্থিত মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি যেন একটি নিঃসঙ্গ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। চার বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কেন্দ্রটি মা ও শিশুর চিকিৎসায় সেবা দিতে পারছে না। অথচ এটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
"হাসপাতাল আছে, সেবা নেই"
শীতলপাটি গ্রামের মো. হামিদুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“সরকার গরিবদের জন্য হাসপাতাল করেছে, যেন আমরা কম খরচে চিকিৎসা নিতে পারি। কিন্তু এখানে ডাক্তার থাকেন না, ওষুধ থাকে না। তালা থাকে, সেবা থাকে না।”
তার মতো অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরেছেন। কেউ এসেছেন গর্ভবতী স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে, কেউ এসেছেন শিশুর জ্বর নিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে যেতে হয়েছে খালি হাতে।
‘খোলা’ হাসপাতালে তালাবদ্ধ সেবা
গত সপ্তাহে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফটক খোলা থাকলেও ভবনের প্রায় সব কক্ষ তালাবদ্ধ। অফিস সহায়ক রফিকুল ইসলাম জানান,
“এখানে একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন পরিদর্শিকা আছেন। চিকিৎসক সপ্তাহে দুদিন আসেন। আজ ছুটিতে।”
অর্থাৎ, সপ্তাহে ৫ দিনই হাসপাতাল কার্যত অচল।
অব্যবহৃত আধুনিকতা, অলস কোটি টাকার অবকাঠামো
২০২০ সালে উদ্বোধিত এই কেন্দ্রটিতে রয়েছে—
দুটি তিনতলা ভবন (একটি হাসপাতাল, একটি আবাসিক কোয়ার্টার)
১০টি শয্যা
১০টি কেবিন
২টি ওয়ার্ড
একটি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার
কিন্তু জনবলসংকটে এসব শুধু 'অবকাঠামো' হয়েই রয়ে গেছে।
১০ পদের মধ্যে ৮টিই শূন্য
হাসপাতালে মোট পদ: ১০টি
নিয়োজিত: মাত্র ৩ জন (তাও সংযুক্তিতে)
বাকিরা অনুপস্থিত। সিজার, জরুরি সেবা তো দূরে থাক, সাধারণ পরামর্শ দিতেও একজন চিকিৎসক পাওয়া যায় না।
পরিদর্শিকা গীতা রানী বিশ্বাস বলেন,
“একজন নারী হিসেবে আমি চেষ্টা করি গর্ভবতী মায়েদের সেবা দিতে। কিন্তু ডেলিভারি, সিজার কিছুই দিতে পারি না। একার পক্ষে সম্ভব না। মেডিকেল অফিসার, আয়া, নাইট গার্ড, এমএলএস—সবকিছুর সংকট আছে।”
ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি না, বর্তমানের দায়িত্ব জরুরি
জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক আলিফ নূর দাবি করেন,
“আমাদের উপজেলা মেডিকেল অফিসার সুবিধাজনক সময়ে যান। প্রতিদিন খোলা থাকে।”
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বাস্তবতা ভিন্ন। তালা-বন্ধ ভবনের ছবি তাঁরা বহুবার নিজের চোখে দেখেছেন, সেবা পাননি।
৪০ হাজার মানুষের একটিমাত্র ভরসা, সেটিও ঝিমিয়ে পড়া
পেড়লি, পাঁচগ্রাম ও সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের অন্তত ৪০ হাজার মানুষ এই হাসপাতালটির ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনবল ও ওষুধের অভাবে তা হয়ে উঠেনি ভরসার নাম।
কোটি টাকার গাছ, কিন্তু ফল নেই
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে শুধু ভবন নয়, মানবিক উপস্থিতি নিশ্চিত করাটাই এখন সময়ের দাবি। নইলে হাসপাতালগুলো পরিণত হবে মানুষের আশাভঙ্গের জায়গায়।
পেড়লির মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি সেই বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। এখানে মানুষ ফিরে যায়—প্রতিবারই খালি হাতে, একরাশ অভিমান নিয়ে।
