রাবি শিক্ষার্থীর পরিচয়ে লক্ষাধিক টাকার প্রতারণা: নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ভুক্তভোগী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থীর পরিচয় ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া প্রোফাইল খুলে অনলাইনে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র। জাতীয় পরিচয়পত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড, হল কার্ড ও ব্যক্তিগত ছবি চুরি করে এ চক্রটি ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডলার লেনদেনের নামে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান মারাত্মক সামাজিক, মানসিক ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিতে পড়েছেন।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি। মুশফিকুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায়।
বিষয়টি জানার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সহায়তায় মতিহার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও এখনো কোনো কার্যকর সমাধান মেলেনি বলে জানান।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মুশফিকুর বলেন, আজ আমি এক ভয়াবহ ও চরম নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে এসেছি। গত কয়েক মাস ধরে আমি এবং আমার পরিবার এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে সময় পার করছি। একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আমার পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত সাধারণ মানুষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।
তিনি আরও জানান, এই প্রতারণার মাধ্যমে ইতোমধ্যে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা—যার চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত আমি, কারণ আমার পরিচয় ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতারিত ব্যক্তিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে আমাকে বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক মনে করছেন। আমি প্রতিনিয়ত হুমকি, গালাগালি, প্রাণনাশের ভয় এবং সামাজিক অপমানের শিকার হচ্ছি।
মুশফিকুর জানান, ৮ অক্টোবর ২০২৪ সালে ক্যাম্পাসে অবস্থানকালে জানতে পারেন, তাঁর পরিচয় ব্যবহার করে এক প্রবাসীর কাছ থেকে প্রায় ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকচক্র। ওই প্রবাসী তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সেখান থেকেই পুরো ঘটনার শুরু জানা যায়।
এরপর বিভাগের এক শিক্ষকের পরামর্শে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে যান এবং ৯ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে মতিহার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর: ৩৯৯) করেন। পরে এক সিনিয়রের পরামর্শে রাজশাহী র্যাব-৫ কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেন।
প্রতারকদের বিষয়ে সতর্ক করতে তিনি নিজ ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন—আমার নাম ব্যবহার করে কেউ যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডলার লেনদেনের প্রস্তাব দেয়, তা যেন কেউ বিশ্বাস না করেন এবং লেনদেনে জড়িত না হন।
তবে দুই দিনের মধ্যেই ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ ফেসবুক গ্রুপে ‘সমাসুদ’ নামের এক ব্যক্তি তাঁর নাম উল্লেখ করে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ করেন। এরপর একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে এবং কিছু ব্যক্তি সরাসরি তাঁর বাড়িতে গিয়েও হুমকি দিতে শুরু করেন।
মুশফিকুর জানান, প্রতারকচক্রের কারণে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা—ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর, রাজশাহী এবং প্রবাসেও অনেক ব্যক্তি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
প্রতারিত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন—ফতে মাহমুদ রাফি (প্রবাসী), মাহমুদুল খান (ময়মনসিংহ), রাকিব হাসান (সিরাজগঞ্জ), সুমন মিয়া (শেরপুর), মাসুদ (রাজশাহী), সাজিদ (রাজশাহী) এবং আরও অনেক অজানা ভুক্তভোগী।
তিনি বলেন, এটি শুধু আর্থিক প্রতারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সামাজিক সম্মান, মানসিক স্বাস্থ্য এবং পারিবারিক শান্তির ওপরও আঘাত করেছে। প্রতারিত ব্যক্তিরা ফোনে ও মেসেজে আমাকে হুমকি দিচ্ছেন, গালাগালি করছেন। কেউ কেউ রাজশাহীতে আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েও ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
তাঁকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে—"রাস্তায় যেখানে পাব, সেখানেই মেরে টাকা আদায় করব," "তোকে বাঁচতে দেব না, দেখে নেব," "প্রতারক, তোর বিচার জনগণ করবে," "তুই প্রতারক, তোকে বিশ্বাস করি না," "তোকে কোর্টে মামলা দিয়ে জেলে পাঠাব।"
তিনি বলেন,প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমি এবং আমার পরিবার আতঙ্কের মধ্যে আছি। ক্যাম্পাসে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছি না। পড়াশোনা ও স্বাভাবিক জীবন ভীষণ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। প্রতারকচক্রের কারণে আমার শিক্ষা জীবন, সামাজিক সম্মান ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইনের আশ্রয় নেওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত চক্রটির কাউকে শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করা যায়নি। ফলে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা ও ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, পরিস্থিতির কারণে তিনি সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী কোর্টে মামলা দায়েরের উদ্যোগ নিয়েছেন।
সবশেষে মুশফিকুর রহমান অনুরোধ করেন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য কোনো মাধ্যমে যদি আমার নাম ব্যবহার করে কেউ ডলার লেনদেনের প্রস্তাব দেয়, তাহলে কেউ যেন কোনো আর্থিক লেনদেনে না জড়ান এবং সরাসরি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবর রহমান বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিষয়টি পুরনো হলেও যেহেতু এখনো সমাধান হয়নি, তাই আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলে দেখছি কী করা যায়।
মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মালেক বলেন, বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। সাইবারে পাঠানো হওয়ার কথা। তবে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
