সুনামগঞ্জ সীমান্তে কোটি টাকার চোরাই ভারতীয় পণ্য জব্দ, ছায়াপথে সক্রিয় চোরাকারবারিরা

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলা যেন চোরাকারবারিদের জন্য এক গোপন করিডোরে পরিণত হয়েছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা প্রায় ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী, খাল, হাওর ও জঙ্গলে ভরপুর এই জনপদে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী চোরাই পণ্যের সিন্ডিকেট। প্রতিদিন রাতের আঁধারে লাখ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য অবাধে ঢুকছে এসব সীমান্ত দিয়ে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারিতে বারবার বিপাকে পড়ছে এই চোরাকারবারিরা।
সোমবার (৩০ জুন) রাত আড়াইটার দিকে সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (২৮ বিজিবি)-এর একটি বিশেষ আভিযানিক দল চোরাচালান প্রতিরোধে রঙ্গারচর ইউনিয়নের হরিণাপাটি গ্রামের একটি টিনশেড গোডাউনে অভিযান চালায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ চোরাই ভারতীয় পণ্য।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, অভিযানে ৪ হাজার ২৮৬ পিস ভারতীয় শাড়ি, ১৩টি লেহেঙ্গা, ৪ হাজার ৯৯২ পিস বিভিন্ন কসমেটিকস সামগ্রী এবং ২০ হাজার ১২০ পিস চকলেট জব্দ করা হয়। এসব পণ্যের আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৭১ হাজার ৫২০ টাকা।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান হৃদয়। তার সঙ্গে ছিলেন বিজিবির সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত কোয়ার্টার মাস্টার, সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন) এবং দুই পুলিশ সদস্যসহ ২০ সদস্যের একটি টিম।
সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে এম জাকারিয়া কাদির জানান, “চোরাচালান রোধে আমাদের আভিযানিক কার্যক্রম এবং গোয়েন্দা তৎপরতা সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন সদর দপ্তরের নির্দেশ অনুযায়ী সীমান্ত সুরক্ষায় আমরা আপসহীন।”তিনি আরও বলেন, “জব্দকৃত পণ্যসমূহ সুনামগঞ্জ শুল্ক কার্যালয়ে জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চোরাচালান প্রতিরোধে আমাদের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
বিজিবি সূত্র বলছে, ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে বিলাসবহুল ভারতীয় পণ্য—বিশেষ করে শাড়ি, লেহেঙ্গা, কসমেটিকস, চকলেট, পানীয়সহ নানা ধরনের চাহিদাসম্পন্ন পণ্য। ঈদ, পূজা কিংবা উৎসব এলেই চাহিদা বেড়ে যায় এসব পণ্যের। চোরাকারবারিরা সীমান্তের দুর্বল পয়েন্ট ব্যবহার করে নৌকা, গরুর পাল কিংবা স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে এসব পণ্য বাংলাদেশে এনে ঢাকার পাইকারি বাজারে পৌঁছে দেয়।
সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (২৮ বিজিবি)-এর চলতি মাসের (জুন) অভিযানে এটি সবচেয়ে বড় চালান হলেও পুরো মাসজুড়ে মোট ১৪ কোটি ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৮ টাকা মূল্যের ভারতীয় পণ্য আটক করা হয়েছে। যা সীমান্তের সক্রিয় চোরাকারবারি নেটওয়ার্কের প্রমাণ বহন করে।
স্থানীয়রা বলছেন, “সীমান্তজুড়ে রাত হলে চোরাকারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে বিজিবি তৎপর হলেও চোরাকারবারিরা আবার ফিরে আসে।” এ অবস্থায় সীমান্ত নিরাপত্তা আরও জোরদার করার দাবি জানান তারা। তবে বিজিবি বলছে, সীমান্তে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চোরাকারবারিদের দমনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সুনামগঞ্জ সীমান্তের ছায়াপথে জমে ওঠা চোরাইপণ্যের এই বিশাল সিন্ডিকেট শুধু আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি নয়, বরং দেশের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত নজরদারি আরও জোরদার করা ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। বিজিবির এমন সাফল্য প্রশংসনীয় হলেও, ভবিষ্যতে চোরাচালান রোধে আরো প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ও স্থানীয় জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।