টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় নতুন প্রকল্প: জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পাঁচ বছর মেয়াদি উদ্যোগ

বাংলাদেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় শুরু হলো পাঁচ বছর মেয়াদি একটি নতুন প্রকল্প। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে সোমবার আয়োজিত এক কর্মশালায় এই প্রকল্পের সূচনা ঘোষণা করা হয়। প্রকল্পটির নাম ‘টাঙ্গুয়ার হাওর: জলাভূমি বাস্তুতন্ত্রের সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা’, যা পরিচালিত হবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর যৌথ ব্যবস্থাপনায়। প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ৪৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে হাওরের জলাভূমির সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা, যার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হবে। এর আওতায় সংকটাপন্ন জলাবন ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল পুনরুদ্ধার, বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা, এবং অভয়াশ্রম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক শাহেদা বেগম কর্মশালায় জানান, হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ৩৮০টি পরিবারকে বিকল্প আয় বৃদ্ধির সুযোগ, জলাভূমি বাগান, মৎস্য ও জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ১০টি অভয়াশ্রম এবং ইকোসিস্টেমের আর্থিক মূল্যায়ন এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সমর কুমার পাল। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অঞ্জন কুমার দেব রায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ সোলায়মান হায়দার সঞ্চালনায় ছিলেন।
বক্তারা বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই হাওর রক্ষায় পরিকল্পিত ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে। সংকট ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকেই যেতে হবে, যাতে প্রকৃতপক্ষে হাওরের মানুষ উপকৃত হয়।
মুক্ত আলোচনায় হাওরপাড়ের মানুষজন বলেন, গত দুই দশকে বহু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আসেনি। বরং প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে, আস্থা কমেছে। গাছ, মাছ, পাখির সংখ্যা কমেছে, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি এ কে এম আবু নাছার বলেন, “হাওর নিয়ে অতীতে অনেক কিছু হয়েছে, যার বেশিরভাগই লোকদেখানো প্রকল্প ছিল। প্রকৃতির উন্নয়ন হয়নি, বরং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়েছে।”
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায়, শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট, যা ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। এর আগে ১৯৯৯ সালে একে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। এরপর হাওরের ইজারাদারি ব্যবস্থা বন্ধ করে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। পরে এটি জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে আসে।
এই হাওর দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত, প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদ। এটি শুধু জীববৈচিত্র্য নয়, মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও মানুষের জীবিকার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ একটি বাস্তুতন্ত্র।
নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা ও অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগে যদি কাজ করা হয়, তাহলে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।