অবহেলায় ঝিমিয়ে পড়েছে কাঁসা-পিতলের ঐতিহ্যবাহী শিল্প, হারিয়ে যাচ্ছে বিক্রমপুরের শত বছরের গৌরব

আজ আর কারো ঘুম ভাঙে না হাতুরির টুংটাং শব্দে। সময়মতো কাজে যাওয়ার ব্যস্ততাও যেন হারিয়ে গেছে অনেক পরিবারে। খেটে খাওয়া মানুষের সেই পরিচিত ব্যস্ততা আজ অতীত। আর নেই দিঘলীর পালের বাজারের কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়েছে লৌহজংয়ের নাগের হাটের কাঁসা-পিতলের দোকানপাট।
এক সময় এই অঞ্চলের কাঁসা ও পিতলের বাসনপত্র ছিল অভিজাত্যের প্রতীক। স্বর্ণের পরেই স্থান ছিল এই ঝকঝকে ধাতব সামগ্রীর। কিন্তু কালের পরিবর্তনে সেই ঐতিহ্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় পদ্মা নদীর ভাঙনে অনেকেই পেশা হারিয়েছেন। পালের বাজার আর নাগের হাট— যেখানে একসময় দেড় শতাধিক দোকান ও কারখানা ছিল, সেখানেই এখন মাত্র ৫-৬টি দোকান এবং ২-৩টি কারখানা টিকে আছে। সেগুলোও অর্থসংকটে ধুঁকছে।
কনকসার বাজারের কাঁসারু পট্টির মো. রিয়াজ মাল দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। আগে কারিগর ছিলেন, এখন ব্যবসার হাল ধরেছেন। কিন্তু তিনি বললেন, “অর্থের অভাবে টিকতে পারছি না। পদ্মার ভাঙন সব কেড়ে নিয়েছে।"
এক সময় হাড়ি-পাতিল, পূজার বাটা, থালা, পানদান, কলস, চারি, মগসহ নানা জিনিসপত্র তৈরি হতো কাঁসা-পিতলে। এখন তা অতীত স্মৃতি। আধুনিক মেলামাইন ও স্টিলের আধিপত্যে বাজার হারিয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী।
স্থানীয় কারিগর শামসুন্দর কংস বণিক জানান, তার কারখানায় ৩ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী শ্রমিক কাজ করেন। কেজি প্রতি ৪০ টাকা মজুরিতে একজন শ্রমিক দিনে ১০–১২ কেজি কাজ করতে পারেন। এতে দিনে ৪০০–৪৫০ টাকা আয় হয়।
নারী শ্রমিকরা ঘরে বসে সংসারের কাজের ফাঁকে কাজ করে সংসারে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। তবে বাজারে চাহিদা না থাকায় অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন।
বর্তমানে তামার দর ৬৫০ টাকা, কাঁসা ১,৬৫০ টাকা ও পিতল ৪৯০ টাকা হলেও পণ্যের চাহিদা এতটাই কম যে পুঁজি ফিরে পাওয়া মুশকিল।
নাগের হাটের গোবিন্দ্র কংস বণিক, যিনি এই পেশায় পঞ্চম প্রজন্ম, বলেন, “আমার পরিবার ২০০ বছর ধরে এই পেশায়। আমি শেষ ব্যক্তি, যে এখনো চেষ্টা করছি শিল্পটা ধরে রাখার।”
ঢাকার ধামরাই, টাঙ্গাইলের কাগমারি, জামালপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ— দেশের বহু স্থানে কাঁসা-পিতলের কারখানা ছিল। আজ সেসব জায়গা হারিয়ে গেছে, কোথাও টিকে আছে নিভু নিভু আলো। লৌহজংয়ে এখন কেবল ৪টি কারখানা টিকে আছে।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য করা হলে এবং সরকার প্রণোদনা দিলে এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এক ব্যবসায়ীর ভাষায়, “সরকারি ব্যাংক যদি সহজ শর্তে ঋণ দেয়, তবে আমরা আবার গড়তে পারি আমাদের ঐতিহ্য।”
স্থানীয় লেখক মো. মিজানুর রহমান ঝিলু বলেন, “কাঁসার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। চৈনিক সভ্যতায় এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। প্রাচীনকালে কাঁসা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে যুদ্ধসামগ্রী বানানো হতো। আমাদের উপমহাদেশেও এটি আভিজাত্যের প্রতীক ছিল ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত।”
তিনি যোগ করেন, “এগুলো শুধু পণ্য নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। শিল্পটি হারিয়ে যাওয়া মানে একটি ইতিহাস হারিয়ে যাওয়া।”
এক সময়ের ঐতিহ্য আজ নিঃশেষ হওয়ার পথে। কাঁসা-পিতলের এই শিল্প শুধু পণ্যের নয়, মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সময় এখনই— প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ, সহজ ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার সম্প্রসারণ। নয়তো বিক্রমপুরের গর্বও হারিয়ে যাবে ইতিহাসের গহ্বরে।