সংস্কার প্রক্রিয়ায় গভীর সম্পৃক্ততা: ছয় কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশে একমত বিএনপি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীনে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের বেশিরভাগ সুপারিশে একমত হয়েছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৫৮৭টি সুপারিশের মধ্যে তারা একমত হয়েছে ৪৩৬টিতে, আংশিকভাবে একমত ২৮টিতে এবং মাত্র স্বতন্ত্রভাবে মত দিয়েছে বাকি সুপারিশগুলোতে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, গঠনমূলক অংশগ্রহণ ও সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েই তারা সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
ছয়টি কমিশনের মধ্যে পাঁচটিতে সম্পন্ন মতামত, পুলিশ সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে
বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে দলটি ইতোমধ্যে দফায় দফায় আলোচনা করে তাদের মতামত জানিয়ে দিয়েছে। তবে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয়ে চূড়ান্ত মত নির্ধারণ হয়নি, যদিও র্যাব বিলুপ্তিসহ অধিকাংশ প্রস্তাবে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে।
দুদক সংস্কার কমিশনের ৪৭টি সুপারিশের মধ্যে ৪৬টিতে একমত বিএনপি। কেবল ২৯ নম্বর সুপারিশে তারা মতানৈক্য পোষণ করেছে—যেখানে আদালতের অনুমতি বাদ দিয়ে আইনের মাধ্যমে অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছিল। বিএনপির মতে, এতে দুর্নীতি দমন বিলম্বিত হতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮ সুপারিশের মধ্যে দলটি ১৮৭টিতে একমত, ৫টিতে আংশিক এবং ১১টিতে ভিন্নমত দিয়েছে। ভিন্নমতের মধ্যে রয়েছে প্রদেশ গঠন ও পদোন্নতির নীতিমালায় প্রস্তাবিত কিছু পরিবর্তন।
বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের ৮৯ সুপারিশের মধ্যে ৬২টিতে একমত এবং ৯টিতে আংশিক মত দিয়েছে বিএনপি। ১৮টি প্রস্তাবে যুক্তিসহ ভিন্নমত জানানো হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার প্রস্তাবগুলোতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে দলটি, তবে সংসদে আইন পাস ও সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে বিএনপি একমত হয়েছে ১৪১টিতে, আংশিকভাবে একমত ১৪টিতে, ৬৪টিতে শর্তসাপেক্ষে মত দিয়েছে এবং ২৪টিতে আপত্তি জানিয়েছে। দলটি মনে করে, কিছু সুপারিশ কমিশনের সাংবিধানিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে এবং বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
বিএনপির দাবি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশের বেশিরভাগেই তারা একমত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা—এসব গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশে দলটি সম্মত হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ নির্ধারণের বৈশ্বিক নজির না থাকলেও, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তারা এতে একমত হয়েছে।
বিএনপির মতে, অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন কঠিন হলেও তারা রাষ্ট্র গঠনে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্মত হয়েছে। তবে এমন কোনো প্রস্তাবে সমর্থন দেয়নি, যা সংসদ বা সরকারকে অকার্যকর করে তুলবে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “নির্বাচিত সংসদ ও সরকারকে দুর্বল করা সংস্কারের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। তাই এসব বিরোধিতাই প্রকৃত অর্থে সংস্কারকে রক্ষা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অতি ক্ষমতাধর করলেও ফ্যাসিবাদ আসে। আবার নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাহীন করলেও রাষ্ট্র ভঙ্গুর হয়। বিএনপি এ ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।”
স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আমরা আমাদের মতামত বহু আগেই দিয়েছি। যারা এখনও দেয়নি বা বিলম্ব করছে, তার দায় বিএনপির নয়।”
আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণসহ আমরা অনেক ছাড় দিয়েছি। এনসিসি জাতীয় সরকার ধারণায় আমরা একমত হইনি। কিন্তু আলোচনায় সম্মান রেখে গঠনমূলক মত দিয়ে যাচ্ছি।”
বিএনপির এই উদ্যোগ স্পষ্ট করে যে তারা সংস্কার প্রক্রিয়াকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ভবিষ্যৎ রূপরেখা হিসেবেই বিবেচনা করছে। তবে বাস্তবায়নে অগ্রগতি নির্ভর করছে অন্য অংশীজনদের আন্তরিকতার ওপর।