নতুন রেকর্ড গড়লো পাগলা মসজিদের দান বক্সের টাকা

কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ, যেনো আজব এক টাকার গাছ। যেখানে প্রতি তিন মাস পর ঝাঁকি দিলেই পড়ে কোটি কোটি টাকা। প্রতিবারই হয় টাকার রেকর্ড, তার আবার ভেঙে যায় পরের বারই। এভাবেই দিন যাচ্ছে, আর রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে পাগলা মসজিদের টাকা।
পাগলা মসজিদের বস্তা বস্তা টাকা দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে আলমগীর হোসাইন নামক এক দর্শনার্থী বলেন, এতো টাকা একসাথে আমি কখনও দেখেনি। মনে হচ্ছে আমি টাকার রাজ্যে চলে এসেছি । সারি সারি লাইনে বসে টাকা গুনছেন মাদ্রাসার শত শত শিক্ষার্থীরা। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
শনিবার (১২ এপ্রিল) সকাল ৭টায় জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীর উপস্থিতিতে ৪ মাস ১১ দিন পর কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের ১১টি দানবাক্স (সিন্দুক) খোলা হয়। আর এতেই মিলে দানবাক্স থেকে মেলে ২৮ বস্তা টাকা। পরে বস্তা বস্তা এসব টাকা একে একে নেওয়া হয় মসজিদের দোতলায়। এপর দিনভর চলে গণনার কাজ।
গণনা শেষে এবার দানবাক্স থেকে পাওয়া গেছে মোট ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ টাকা। যা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়।
শনিবার (১২ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টার দিকে গণনা শেষে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দানবাক্স খোলা কমিটির আহ্বায়ক জেসমিন আক্তার। তিনি বলেন, দানবাক্সের এই টাকা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এর আগে তিন মাস ১৪ দিন পর গত বছরের ৩০ নভেম্বর পাগলা মসজিদের দানবাক্সগুলো খুলে রেকর্ড ৮ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৪ টাকা পাওয়া যায়। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান, সহকারী কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি খলিলুর রহমান ও রূপালী ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রফিকুল ইসলামসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষকেরা গণনাকাজ তত্ত্বাবধান করেন।
জানা গেছে, মসজিদের দানের টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে। আর ওই টাকার লভ্যাংশ থেকে ক্যান্সারসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের আর্থিকভাবে অনুদান দিয়ে থাকে মসজিদ কমিটি। যে কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৯ সাল থেকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পাগলা মসজিদের কার্যক্রম চলে আসছে। সেই থেকে পদাধিকার বলে কিশোরগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকেরা পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, টাকা গণনায় পাগলা মসজিদ মাদ্রাসার ১৩০ জন ছাত্র, জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসার ১৫৫ জন ছাত্র, পাগলা মসজিদের ৩৬ জন স্টাফ, রূপালী ব্যাংকের ৭৫ জন কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর ১০ জন সদস্য, ১০ জন আনসার সদস্য, ২০ জন পুলিশ, ৫ জন র্যাব ও জেলা প্রশাসন থেকে ২০ জন কাজ করেছেন। দান সিন্দুকে দান করা ছাড়াও মসজিদের নিলামঘরে প্রতিদিন মানুষ নানা ধরনের জিনিসপত্র দান করেন। প্রতিদিন এসব নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
মসজিদ পরিচালনা কমিটি জানায়, মুসলমানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন এ মসজিদে দান করেন। এখানে দান করলে মনোবাসনা পূরণ হয়—এমন বিশ্বাস থেকে তাঁরা ছুটে আসেন। এ মসজিদের দানবাক্সে যে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, তা জেলার আর কোনো মসজিদে পাওয়া যায় না। টাকার সঙ্গে সোনা-রুপার অলংকারসহ থাকে বিদেশি মুদ্রাও।
তাছাড়া প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, ফলফলাদি, মোমবাতি ও ধর্মীয় বই দান করে লোকজন। আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দানবাক্সে পাওয়া চিঠিপত্র। এসব চিঠিতে লোকজন তাঁদের জীবনে পাওয়ার আনন্দ, না পাওয়ার বেদনা, আয়-উন্নতির ফরিয়াদ, চাকরির প্রত্যাশা, পরীক্ষায় ভালো ফলের আশা ও রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি প্রকাশ করেন। এমনকি শত্রুকে ঘায়েলের দাবিও থাকে কোনো কোনো চিঠিতে।
গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে আসা মাহমুদা বলেন, এ গাগলা মসজিদে সবাই সবার মনের বাসনা পূরণে এখানে আসে। আমিও আমার একটা মনের বাসনা নিয়ে এখানে আসছি।
কুমিল্লা থেকে আসা সুজনের সাথে কথা হয় এ প্রতিনিধির। তিনি বলেন, আমি পরিবার নিয়ে আসছি। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন আগে আসছে। শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে আমিও পরিবার নিয়ে আসলাম। নামাজ আদায় করা এবং বসার স্থান একটু বৃদ্ধি করলে ভালো হতো। লোকজন উপকৃত হতো। পত্রপত্রিকা থেকে জেনেছি এখানে আসলে বা মানত করলে সবার আশা পূর্ণ হয়। আসলে এ উদ্দেশ্যেই আসা।
নরসিংদী রায়পুরা থেকে আসা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মেয়ে বলেন, মানত করেছি। পূর্ণ হলে আবার আসবো।
মসজিদের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান জানান, দানের টাকায় মসজিদের নিয়মিত খরচ চালিয়ে ব্যাংকে জমানো হচ্ছে। ব্যাংকে জমা ৩০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত আছে ৮০ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৬ টাকা। এ টাকা দিয়ে মসজিদের বড়সড় উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। মসজিদ ঘিরে এখানে ছয়তলাবিশিষ্ট একটি ইসলামী কমপ্লেক্স নির্মিত হবে। এতে প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, যেখানে একসঙ্গে ৫০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার নারীর জন্য আলাদাভাবে নামাজের ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ থাকবে আরো বিভিন্ন আয়োজন। এ জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা যাচাই-বাছাই করে ডিজাইন ও নকশা চূড়ান্ত করে দিলেই দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কাজ শুরু হবে।
নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, ‘সকাল ৭টা থেকে আমরা আমাদের টিম নিয়ে কাজ করছি। বিপুল পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী আনসার সদস্য ও গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। টাকা গণনার পর ব্যাংকে নিরাপদে পৌঁছানোসহ নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সারাবছরই পাগলা মসজিদে পুলিশের নিরাপত্তা রয়েছে।’
কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে পাগলা মসজিদ অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে মসজিদটি গড়ে ওঠে। কথিত আছে, খাস নিয়তে এ মসজিদে দান করলে মানুষের মনের আশা পূরণ হয়। সে জন্য দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে দান করে থাকেন।
