পুলিশে দুই স্তরে নিয়োগের চিন্তা, এসআই পদে সরাসরি নয়

পরিকল্পনায় যা আছে
এএসপি ও কনস্টেবল বা এএসআই পদে নিয়োগ।
কনস্টেবল পদোন্নতি পেয়ে হতে পারবেন এএসপি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা।
মেধাবীদের টানতে বিশেষ উদ্যোগ।
তিন স্তরের পরিবর্তে দুই স্তরে নতুন সদস্য নিয়োগ দিতে কাজ করছে পুলিশ। উপপরিদর্শক (এসআই) পদে সরাসরি নিয়োগ না দিয়ে শুধু কনস্টেবল বা সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদে নিয়োগ দিতে চায় বাহিনীটি। আর ওপরের পদে নিয়োগ হবে শুধু সহকারী পুলিশ সুপার বা এএসপি পদে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে এই প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে। এ বিষয়ে মতামত জরিপের জন্য জেলা পুলিশের কাছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দল মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিভিন্ন পদের পুলিশ সদস্যদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিরসন, পদোন্নতি জটিলতা দূর করা এবং পেশাগত উৎকর্ষের জন্যই দুই পর্যায়ে নিয়োগের চিন্তা চলছে। কনস্টেবল থেকে যাঁরা পদোন্নতি পেয়ে এসআই হন, তাঁদের সরাসরি এসআই পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা একটু ভিন্ন চোখে দেখেন। আবার এসআই থেকে যাঁরা এএসপি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা হন, তাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নিচের পদগুলো থেকে পদোন্নতি পেয়ে উঠে আসা কর্মকর্তাদের সুযোগ–সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে অন্য ধাপের কর্মকর্তারা অনেক সময় প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়ান। বাহিনীর সদস্যদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব নিরসন করা দুই ধাপে নিয়োগের চিন্তার অন্যতম কারণ।
পুলিশ সংস্কার কমিশনকে পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া প্রস্তাবে দুই স্তরে নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানে কনস্টেবলদের ১৭তম গ্রেডের পরিবর্তে ১৬তম গ্রেড প্রদান করার কথাও বলা হয়। তবে সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে এই প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় দুই স্তরে নিয়োগের নানা দিক তুলে ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে কনস্টেবলদের গ্রেড পরিবর্তন অথবা ভবিষ্যতে সরাসরি এএসআই পদে নিয়োগ দেওয়ারও চিন্তা চলছে। তাঁরাই পরে যোগ্যতা অনুযায়ী এএসপিসহ তদূর্ধ্ব পদ পর্যন্ত পদোন্নতি পাবেন।
দুই স্তরের নিয়োগের চিন্তা করলে নিচের সর্বনিম্ন পদের নাম ও বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে নিচের ধাপে যোগদানে মেধাবীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন
মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সাবেক আইজিপি এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত পদোন্নতি, মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ঘোচানো এবং মামলার তদন্তের জন্য শুরু থেকেই সব পর্যায়ের সদস্যদের প্রস্তুত করতে কাজ করছে পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে দুই স্তরে নিয়োগের চিন্তা চলছে। এই প্রস্তাব পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
যেভাবে দুই স্তরে নিয়োগের চিন্তা
মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে হয় পুলিশকে। সাধারণত মামলা তদন্তের মূল কাজটি করে থাকেন এসআইরা। পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল (পিআরবি) ১৯৪৩-এর প্রবিধান ৭৪১ অনুযায়ী, পুলিশের মোট এসআই পদের ৫০ শতাংশই হন কনস্টেবল থেকে। মামলা তদন্তে পদোন্নতি পাওয়া এসআইদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি নিয়ে বহুদিন থেকেই আলোচনা রয়েছে। এ অবস্থায় এএসপির নিচে এক স্তরে নিয়োগ দিয়ে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে চায় পুলিশ। তাতে মামলা তদন্তে গুণগত মানের উন্নয়ন হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও বলছেন, সরকারি চাকরির বিদ্যমান ব্যবস্থায় সাধারণত তিনটি পদোন্নতি হলে সেটিকে সন্তোষজনক পদোন্নতি বলা যায়। অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে কারও পাঁচ ধাপ পর্যন্তও পদোন্নতি হতে পারে। তবে পুলিশের ক্ষেত্রে এই পদোন্নতিজট অনেক বেশি। এ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে একধরনের হতাশা রয়েছে। আবার ওপরে পদ তৈরি না করে নিচে অতিরিক্ত নিয়োগের ফলে অনেকেই সময়মতো পদোন্নতি পাচ্ছেন না। দুই ধাপে নিয়োগ হলে অনেকাংশেই এ সমস্যার সমাধান হবে। কনস্টেবলরাই একসময় এএসপি পর্যন্ত পদোন্নতি পাবেন। এতে সদস্যদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ও হতাশাও কমে যাবে।
উপমহাদেশের বাস্তবতায় কনস্টেবল পদে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকেরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। কনস্টেবলদের কাজগুলো করার ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অস্বস্তি থাকতে পারে। দুই স্তরের নিয়োগের চিন্তা করলে নিচের সর্বনিম্ন পদের নাম ও বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে নিচের ধাপে যোগদানে মেধাবীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। সব দিক বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা
দুই স্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে লন্ডন পুলিশের মডেল সামনে রাখছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, লন্ডনে কনস্টেবল পদে নিয়োগ হলে তাঁরাই একসময় কাউন্টির চিফ কনস্টেবল (পুলিশপ্রধান) হন। সেই মডেলকে অনুসরণ করতে চায় পুলিশ।
কমিশনকে দেওয়া প্রস্তাবে যা ছিল
বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশে তিন স্তরে চার ক্যাটাগরিতে পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হয়। প্রথম স্তরে ১৭তম গ্রেডে কনস্টেবল, দ্বিতীয় স্তরে ১০ম গ্রেডে এসআই (নিরস্ত্র) ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগ এবং তৃতীয় স্তরে নবম গ্রেডে এএসপি পদে নিয়োগ হয়। এ ছাড়া পুলিশে বিভিন্ন শ্রেণি বা পদে সিভিল কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
এই নিয়োগপদ্ধতি পরিবর্তন করে সংস্কার কমিশনকে দেওয়া পুলিশের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, পুলিশকে অধিক স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, জনবান্ধব ও সর্বতো গ্রহণযোগ্য বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিন স্তরের পরিবর্তে দুই স্তরবিশিষ্ট নিয়োগপদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ট্রেড পুলিশম্যান ও দাপ্তরিক কাজে নন-পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নির্ধারিত পদে জনবল নিয়োগ করতে হবে। কোন পদে নিয়োগে কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে, পুলিশের প্রস্তাবে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছিল।
কনস্টেবল থেকে যাঁরা পদোন্নতি পেয়ে এসআই হন, তাঁদের সরাসরি এসআই পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা একটু ভিন্ন চোখে দেখেন। আবার এসআই থেকে যাঁরা এএসপি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা হন, তাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।
আছে চ্যালেঞ্জ, প্রয়োজন বাস্তবধর্মী চিন্তা
২০২১ সালে ক্যাডেট এসআই (নিরস্ত্র) পদে অধিক যোগ্য ও মেধাবীদের টানতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে এসআই পদে দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকদের যোগ দেওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সরাসরি এসআই পদে নিয়োগ বন্ধ হলে নিচের স্তরে যোগ দিতে আগ্রহ হারাতে পারেন মেধাবীরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পুলিশে মেধাবীদের নিয়োগের স্রোত যেন কমে না যায়, এ জন্য কনস্টেবল পদে নিয়োগ না দিয়ে সরাসরি এএসআই পদে নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, তা–ও ভাবা হচ্ছে। আবার মেধাবীদের পুলিশে যোগ দিতে কীভাবে আগ্রহী করা যায়, সেই চিন্তাও চলছে। দ্বিতীয় স্তরে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রশিক্ষণের সময় আইন ও পুলিশবিজ্ঞান সম্পর্কে উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। এই স্তরে নিয়োগের প্রাথমিক শর্ত হতে পারে স্নাতক উত্তীর্ণ। পাশাপাশি পদোন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনকে (এসিআর) আরও বেশি গুরুত্ববহ করে তোলা হবে। কর্মজীবনে তার ভূমিকা দেখা হবে।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, উপমহাদেশের বাস্তবতায় কনস্টেবল পদে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকেরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। কনস্টেবলদের কাজগুলো করার ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অস্বস্তি থাকতে পারে। দুই স্তরের নিয়োগের চিন্তা করলে নিচের সর্বনিম্ন পদের নাম ও বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে নিচের ধাপে যোগদানে মেধাবীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। সব দিক বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
