লাল সবুজের পতাকা উড়লো গ্রেট ওয়ালে: শেরপুরের সেলিমের জয়ে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ

চীনের মহাপ্রাচীর—যেখানে ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শারীরিক শক্তির এক অনবদ্য সম্মিলন ঘটে। সেই চ্যালেঞ্জিং রুটে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বের অন্যতম কঠিন ম্যারাথন প্রতিযোগিতা—গ্রেট ওয়াল অব চায়না ম্যারাথন। আর সেখানে, বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন শেরপুরের সন্তান, ইঞ্জিনিয়ার আল আমিন সেলিম।
এই রেসে অংশগ্রহণ ছিল কেবল একটি দৌড় নয়—এটি ছিল আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, এবং মানসিক দৃঢ়তার এক জ্বলন্ত প্রতীক। বাংলাদেশের হয়ে তিনি এই কঠিন ট্রেইল ম্যারাথনের (৪২.১৯৫ কিমি ফুল ম্যারাথন) সমাপ্তি টানেন। কেবল তাই নয়, কঠিন পথ পাড়ি দিতে গিয়ে উচ্চতাজনিত শ্বাসকষ্ট, মাসল ক্র্যাম্প এবং নাক দিয়ে রক্তপাতের মতো সমস্যার মুখেও হাল ছাড়েননি তিনি।
আল আমিন পেশায় একজন বস্ত্র প্রকৌশলী, বর্তমানে একটি চীনা বহুজাতিক কোম্পানির কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। কিন্তু পরিচয়ের চেয়েও তিনি পরিচিত ক্রীড়াঙ্গনের এক নিবেদিত প্রাণ হিসেবে। দৌড় তার নেশা, বাংলাদেশ তার অহংকার। নিজেকে তিনি বলেন “রানার বাই চয়েস, দেশপ্রেমিক বাই হার্ট”।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন শেরপুর রানার্স কমিউনিটি ও উত্তরা ফ্যালকন ক্লাব। শুধু নিজে দৌড়ান না, শেরপুরসহ দেশজুড়ে তরুণদের দৌড় এবং শরীরচর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত কাজ করছেন তিনি। নিজের জেলার মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সচেতনতা বাড়াতে শেরপুরে আয়োজন করেছেন ১০ কিমি রান ইভেন্ট, যেখানে ৫৫০ জন দৌড়বিদ অংশ নিয়েছিলেন। এবার তার নেতৃত্বে শেরপুর হাফ ম্যারাথন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।
চীনের গ্রেট ওয়ালে ম্যারাথনে অংশ নিতে গিয়ে শুরুতেই তাকে লড়তে হয় ভিসা জটিলতা ও একাকীত্বের সঙ্গে। যাত্রা শুরু করেন একাই। প্রতিযোগিতা শুরুর সময় ৪৩টি দেশের পতাকা যখন দুলছিল, তখন সেখানে বাংলাদেশের পতাকা দেখে আবেগে আপ্লুত হন তিনি। তার কথায়, “এই মুহূর্তটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এমন অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।”
প্রথম ৬ কিমি অতিক্রম করতেই শুরু হয় তার শরীরিক বিপর্যয়—নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে, মাসলে টান ধরে, তবুও থামেননি। এমনকি, আর্গানাইজারকে তিনি বলেন ফুল ম্যারাথন থেকে হাফে পরিবর্তন করতে। উত্তরে অর্গানাইজার বলেন, “বাংলাদেশ থেকে তুমি প্রথম, কিছু অর্জন করেই যাও।” সেই একটি কথা তাকে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে সাহস জুগিয়েছে।
শেরপুর রানার্স কমিউনিটির সহ-সমন্বয়ক এসএম জুবায়ের বলেন,“আমরা শেরপুরবাসী হিসেবে গর্বিত। আল আমিন সেলিম ভাই একা গ্রেট ওয়াল জয় করে দেখিয়ে দিয়েছেন—ইচ্ছা আর অধ্যবসায় থাকলে আমাদের মানুষও বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে পারে।”
অন্য সহ-সমন্বয়ক জুবাইদুল ইসলাম বলেন, “শুধু দৌড় নয়, সেলিম ভাই শেরপুরের ক্রীড়া সংস্কৃতিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়। তিনি আমাদের উৎসাহিত করছেন একটি সুস্থ ও খেলাধুলা-ভিত্তিক প্রজন্ম গড়তে।”
শেরপুর রানার্স কমিউনিটির আরেক সহ-সমন্বয়ক ইমরান হাসান রাব্বী বলেন, “আমাদের কমিউনিটির প্রতিষ্ঠাতা আল আমিন ভাই যেভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে শেরপুর এবং বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন, তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। আমরা তাঁর এই সাহসী ও ঐতিহাসিক অর্জনে গর্বিত এবং কৃতজ্ঞ।”
এদিকে ম্যারাথনের রেসের শেষ দিকে তার শরীর ছিল প্রায় ভেঙে পড়া অবস্থায়, কিন্তু মাথায় ছিল একটি কথাই—“দেশের পতাকা যেন ফিনিশিং লাইনে উড়তে পারে।” ৮ ঘণ্টা ৫২ মিনিট ৫২ সেকেন্ড লড়াইয়ের পর যখন তিনি ফিনিশ লাইনে পৌঁছান, তখন চীনারা তাকে চিৎকার করে ‘মেংজিয়ালা মেংজিয়ালা’ (বাংলাদেশের চাইনিজ নাম) বলে ডাকতে থাকে। আর তিনি জয়োল্লাসে উড়ান লাল-সবুজ পতাকা।
আল আমিন সেলিম বলেন, “আমরা খেলাধুলা বলতে কেবল ক্রিকেট-ফুটবলকেই বুঝি। অথচ দৌড়, সাইক্লিং, হাইকিং, সুইমিংসহ নানা মাধ্যমেই বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করা সম্ভব। আমি চাই দেশের প্রতিটি জেলা থেকে দৌড়বিদ তৈরি হোক, যাতে আগামীতে আরও অনেকে বিশ্বমঞ্চে দেশের নাম গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “সুস্থতা হলো সৃষ্টিকর্তার বড় নিয়ামত। আমাদের প্রজন্মকে সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতেই হবে।”
