দুই চ্যাম্পিয়ন মায়ের গল্প

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনের তৃতীয় তলায় বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন। সন্তানরা দাবার বোর্ডে বুঁদ আর বাবা-মা ফেডারেশনের বারান্দায় পায়চারি করছেন। এমন দৃশ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের দাবার প্রায় সবাই পরিচিত।
সময়ের ব্যবধানে অভিভাবকদের মুখের পরিবর্তন হয়। সন্তানের দাবার শখ মিটে যাওয়া, নিজেদের ব্যস্ততা আবার সন্তানরা পরিপক্ব দাবাড়ু হয়ে উঠলে অভিভাবকরা আর সেভাবে ফেডারেশনে আসেন না।
গত অর্ধ যুগের বেশি সময় বাংলাশে দাবা ফেডারেশনের বারান্দা ও নানা কক্ষে নিয়মিত দুই অভিভাবক মুনমুন রেজা ও আফরোজা ইসরাত জাহান। যারা যথাক্রমে বর্তমান দুই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মনন রেজা নীড় ও নোশিন আঞ্জুমের মা।
মায়ের জন্যই আজ আমি দাবাড়ু নীড়। নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি আমাকে নিয়ে আসতেন। ফেডারেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। মায়ের সহযোগিতা ছাড়া আমার দাবা খেলা হয়ে উঠত না।
জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মনন রেজা নীড়
দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত যে কোনো খেলায় জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সেই খেলায় দেশের সেরা ক্রীড়াবিদের স্বীকৃতি। দাবায় দুই বার নারী বিভাগে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন নোশিন আঞ্জুম। গত বছর তিন গ্র্যান্ডমাস্টার ও আন্তর্জাতিক মাস্টারদের পেছনে ফেলে ১৪ বছর বয়সী মনন রেজা নীড় জাতীয় দাবার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। নীড় ও নোশিন দুই চ্যাম্পিয়নের দাবাড়ু হয়ে উঠার পেছনে দুই মায়ের অবদানই সর্বাধিক।
নীড় ও নোশিন দুই চ্যাম্পিয়নের দাবাড়ু হয়ে উঠার পেছনে দুই মায়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি।
মনন রেজা নীড় বেশ সোজাসাপ্টাভাবেই বললেন, ‘মায়ের জন্যই আজ আমি দাবাড়ু নীড়। নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি আমাকে নিয়ে আসতেন। ফেডারেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। মায়ের সহযোগিতা ছাড়া আমার দাবা খেলা হয়ে উঠত না।’
দাবা রেটিং ও নর্ম নির্ভর খেলা। বেশি টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করলে রেটিং ও নর্ম দু'টোর সম্ভাবনাই বাড়ে। বিদেশে সেই টুর্নামেন্ট খেলতে অনেক অর্থকড়ির প্রয়োজন পড়ে। ফেডারেশনের আর্থিক সামর্থ্য নেই তাই প্রায় সময়ই দাবাড়ুদেরই সেই খরচ বহন করতে হয়। নীড়ের দেশের বাইরের টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেন তার মা, ‘আমি তো শুধু খেলি। স্পন্সর ও অর্থ জোগাড় সব কিছুই মা করেন। স্পন্সর পাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর বিষয়। মা আমাকে বিদেশে খেলতে পাঠানোর জন্য স্পন্সরদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবর্ণনীয় কষ্ট করেন’-বলেন নীড়।
২০২২ সালে নোশিন আঞ্জুম প্রথমবার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব তার মা'কে দিলেন, ‘২০২২ সালে আমি অসুস্থ ছিলাম। এক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। মা আমাকে উজ্জ্বীবিত করায় শিরোপা রেসে ফিরে আসি। পরবর্তীতে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হই। ফলে কৃতিত্বটা মায়েরই।’ নীড়ের মতো নোশিনেরও মা-ই একমাত্র ভরসা,'অনেক টুর্নামেন্টে খেলেছি মায়ের জমানো অর্থ দিয়ে। ফেডারেশনের সাপোর্ট কিংবা স্পন্সর পাইনি এমন ঘটনায় মা তার জমি বিক্রির অর্থ আমাকে দিয়েছে খেলার জন্য।’
২০১৪ সাল থেকে দাবা ফেডারেশনে যাতায়াত শুরু নোশিনের। দুই বছর পর থেকে মূলত সিরিয়াসলি খেলা শুরু। দুই বারের জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়ন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। এখনো নোশিনকে খেলতে নিয়ে যান তার মা ইসরাত জাহান, ‘আমি সব সময় চেয়েছি আমার মেয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকুক। এজন্য শুরু থেকেই আমি দাবার সঙ্গে ওকে রেখেছি। শুরুর দিনের মতো এখনও আমি ফেডারেশনে খেলতে নিয়ে যাই।’
অনেক টুর্নামেন্টে খেলেছি মায়ের জমানো অর্থ দিয়ে। ফেডারেশনের সাপোর্ট কিংবা স্পন্সর পাইনি এমন ঘটনায় মা তার জমি বিক্রির অর্থ আমাকে দিয়েছে খেলার জন্য।
জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু নোশিন আঞ্জুম
আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দাবা কোচ। নীড় ও নোশিন দুই জনই তার সামনে বেড়ে উঠেছেন। তাদের দুই মায়ের সংগ্রামও একেবারে কাছ থেকে দেখা শাকিলের, ‘বাংলাদেশের দাবায় নীড় ও নোশিন দুই জনই এখন বড় সম্পদ। তাদের এই পর্যায়ের দাবাড়ু গড়ে তোলার পেছনে দুই মায়ের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের দাবা তো বটেই ক্রীড়াঙ্গনও এই দুই মায়ের কাছে ঋণী।’
দুই চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু।
সব মায়ের জীবনই নানা সংগ্রামের। দুই ‘চ্যাম্পিয়ন’ মায়ের সংগ্রামের মাত্রাও বেশি। মনন রেজা নীড়ের মা মুনমুন রেজা ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী। পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে ধর্মান্তরিত হয়ে শ্রাবণী পোদ্দার থেকে মুনমুন রেজা হয়েছেন। দেড় যুগের বেশি সময় সংসার করার পর প্রায় বছর তিনেক আগে বিচ্ছেদ। এখন নীড় ও তার ছোট ভাইকে নিয়েই সংসার। তিন জনের সংসারের গুরু দায়িত্বও আবার ১৫ বছর বয়সী নীড়ের কাঁধেই, ‘আমার এই বাচ্চা ছেলের আয়েই চলে সংসার। আগে পুলিশে ছিল এখন নীড় নেভীতে চুক্তিবদ্ধ। নীড়ের মাসিক সম্মানী আয় (৩০ হাজার টাকা) দিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করি।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিঙ্গেল মায়ের পথচলা অনেক কষ্টের। পারিবারিক-সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ছেলেকে দেশের একটি খেলার সেরা করেছেন। এই সংগ্রামী পথচলা নিয়ে মুনমুনের প্রতিক্রিয়া,‘নানা সমস্যার মধ্যেও ছেলেকে দাবায় মনোযোগ রাখার চেষ্টা করি। এমনও অনেক ঘটনা রয়েছে তিন দিন পর খেলা অথচ টিকিট ও টাকা কিছুই জোগাড় হয়নি। নীড় জানত না আসলেই খেলতে পারবে কি না। এ রকম চাপ নিয়েই ও খেলে আসছে। প্রশিক্ষণ, কোচিং তেমন পায়নি; সম্পূর্ণ নিজের মেধাতেই এই পর্যন্ত।’
নীড়ের মতোই পরিস্থিতি নোশিনের। তিনিও নৌবাহিনীর খেলোয়াড়। তার আয়ের ওপরই (মাসিক ৩৫ হাজার টাকা) মূল ভরসা মা ও এক ভাইয়ের। পারিবারিক সংকট কাটিয়ে দাবা অঙ্গনে এখনো আছেন নোশিন এজন্য আবারো মায়ের অবদান উল্লেখ করলেন, ‘কয়েক বছর আগে পারিবারিক অনেক সমস্যার মধ্যে ছিলাম। এত চাপের মধ্যে থেকে খেলাধুলা ছাড়ার উপক্রম ছিল। মা সব কিছু সামলে আমাকে পড়াশোনা ও দাবায় মনোযোগ দেয়াতেই আবার স্বাভাবিক হয়ে খেলতে পারছি।’
