“ঘোড়ার জন্য নয়, দোয়া চাই”: মনু মিয়ার গল্প বললেন অভিনেতা খায়রুল বাসার

৪৯ বছর ধরে বিনাপারিশ্রমিকে মানবসেবা করে গেছেন কিশোরগঞ্জের ইটনার মনু মিয়া। চার যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি কবর খননকাজ করে গেছেন। অত্র এলাকায় তিনি ‘গোরখোদক’ হিসেবে বেশ পরিচিতি পান। আশপাশ এলাকার মুসলিম রীতি অনুযায়ী তিনি কবর খননকাজ করে এ নজির স্থাপন করেন।। দীর্ঘ এই সময়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি কবর খনন করেন মনু মিয়া। কিন্তু কোনো প্রকার অর্থ কিংবা উপহার তিনি কারও কাছ থেকেই নেননি। কোনো গ্রামে মৃত্যুর খবর পেলেই নিজের লাল রঙের ঘোড়ায় পৌঁছে যেতেন মনু মিয়া।
সেই ৬৭ বছরের মনু মিয়া আজ (২৮ জুন) সকাল ১০টায় মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুর খবর জেনে অভিনেতা খায়রুল বাসার সামাজিক মাধ্যমে একটি আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন।
সেই পোস্টে এ অভিনেতা লিখেছেন—মনু কাকা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এতদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন। তিন দিন আগে উনি বাড়ি ফিরেছেন। বলছিলেন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ আছেন। উনার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার ইচ্ছা আল্লাহ কবুল করেছেন। সুস্থ থেকেই উনি আল্লাহর ডাকে ফিরতে চেয়েছিলেন এ দোয়াও চাইতেন-বলতেন।
তিনি বলেন, হয়তো নিজ গ্রাম, নিজের জন্মস্থান থেকেই আল্লাহ তাকে ডেকে নেবেন এই চেয়েছেন আল্লাহ। উনার মহৎ কর্মের ফলস্বরূপ আল্লাহ নিশ্চয়ই উনাকে উনার স্বপ্নের ঘোড়া উপহার দেবেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন। সবাই মনু কাকার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহতায়ালা তাকে শান্তিতে রাখুন। আমিন।
এর আগে ‘গোরখাদক’ মনু মিয়ার সঙ্গে বুক মিলিয়েছিলেন ছোটপর্দার অভিনেতা খায়রুল বাসার। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সুযোগে দুষ্কৃতকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার ঘোড়াটিকে হত্যা করে। যে ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে। সেই ঘটনার পর ‘গোরখোদক’ মনু মিয়ার পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন খায়রুল বাসার।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে অভিনেতা বলেছিলেন, মনু মিয়াকে আমি ঘোড়া কিনে দিতে চাই। আমার কবর খোঁড়ার আগ পর্যন্ত আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখেন। এ অভিনেতা আরও বলেন, যদি কেউ মনু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন, তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
একজন সাধারণ মানুষ, যিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেই মানুষটির নাম মনু মিয়া। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। এই সময় পাশে দাঁড়ালেন জনপ্রিয় অভিনেতা খায়রুল বাসার।
অভিনেতা খায়রুল বাসার এক হৃদয়ছোঁয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে মনু মিয়ার সঙ্গে নিজের কথোপকথন তুলে ধরেন। তিনি জানান, প্রথমে ফোনে কথা হয় তাদের মধ্যে, পরে হাসপাতালে গিয়ে সরাসরি দেখা করেন মনু মিয়ার সঙ্গে। সেখানেই একটি ঘোড়া কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দেন বাসার, কিন্তু মনু মিয়া বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
মনু মিয়ার জবাব ছিল, “ঘোড়ার জন্য আমার কষ্ট নাই। কারা মারছে সেটা নিয়েও কষ্ট নাই। চোখে দেখি নাই, তাই কষ্টও ঠিক আসে না।” তিনি আরও বলেন, “১০ মণ খড় আর ১০ মণ কুড়া কিনেছিলাম তার জন্য, অল্প খাইয়ে চলে এসেছিলাম ঢাকায়। ফিরলে এই খড়-কুড়া দেখে কষ্ট হবে।”
মনু মিয়ার শান্ত গ্রহণযোগ্যতা, তার মানবিকতা, তার নিজস্ব বেদনা লুকিয়ে রাখার শক্তি খায়রুল বাসারকে আবেগে আপ্লুত করে। বাসার বলেন, “আর কতটা অভিনয় করলে সন্তানের প্রতি মায়া আড়াল করতে পারবেন, মনু চাচা ভেবে পাচ্ছেন না!”
এই মানুষটির স্বপ্ন ছিল—হাতেমতাইয়ের মতো মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ঘোড়ার পিঠে চড়ে দরিদ্রদের সেবা করা। নিজের সীমিত সামর্থ্যে তিনি নিঃস্বার্থভাবে সেই কাজটাই করেছেন আজীবন। ঘোড়াটি তার শখ নয় শুধু, ছিল তার সাধনার সাথী। অথচ এত বড় ক্ষতির পরেও তার মুখে নেই অভিযোগ, নেই অনুযোগ—শুধু দোয়ার আবেদন।
খায়রুল বাসার বলেন, “উনি কারো কাছে ঘোড়া চান না, দোয়া চান। সুস্থ হয়ে ফিরে গেলে ৭টা ঘোড়া কিনবেন—এটাই তার আত্মবিশ্বাস।”
এই ঘটনার পর অনেকেই বলছেন—মনু মিয়ার মতো মানুষেরা আমাদের সমাজের ‘আনসাং হিরো’। তিনি একজন নিঃস্বার্থ মানবিক সৈনিক, যিনি প্রমাণ করেছেন, দুনিয়ায় এখনো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, ত্যাগ আর মানবিকতা বেঁচে আছে।
